Subrata Roy: হকারি থেকে সাহারাশ্রী, তারপর কীভাবে ‘মরুভূমি’ হয়ে গেলেন সুব্রত?

Spread the love

Story of Subrata Roy: চাকরি খোঁজার ‘বিলাসিতা’ ছাড়তে হল তাঁকে। খুলে ফেললেন নিজের ব্যবসা। সংস্থার নাম জয়া প্রোডাক্টস। পাপড়, নিমকি এই ধরনের খাবার প্যাকেটে ভরে নিজের বাবার রেখে যাওয়া স্কুটার চেপেই বিক্রি করতে যেতেন তিনি। কিন্তু ব্যবসা খুললেও, তা যে খুব একটা চলত এমন নয়। আয় হচ্ছিল, কিন্তু তা দিয়ে গোটা জীবন চালানো যাবে, এমনটা নয়।

একজন হকার ভারতের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী সংস্থার মালিক। কিন্তু মালিক হয়েও তিনি ছিলেন কর্মীই। তাই তো নিজেকে ডিরেক্টর নয়, বলতেন ‘ম্যানেজিং ওয়ার্কার’। দেখেছেন জমিদারি পরিবারের বিলাসবহুল জীবন, দেখেছেন অর্থাভাবও। মানুষ ভাগ্যের ফের বলুক আর সাফল্য একাংশের ভারতবাসীর কাছে সুব্রত রায় ভগবান তূল্য, আরেক একটা বড় অংশের কাছে তিনি ‘চোর’। আর আইন মহলে সুব্রত রায় এই ভূভারতের সবচেয়ে বড় হাই প্রোফাইল কেস। যার একটা বিজ্ঞাপনের কারণে হওয়া পতন সবাই দেখেছে, কিন্তু উত্থান?

ইংরেজিতে একটি কথা রয়েছে, ‘The world remembers the first’ অর্থাৎ, এই বিশ্ব প্রথম মানুষ বা প্রথম হওয়া ব্য়ক্তিটাকেই মনে রাখে। দ্বিতীয় বা তৃতীয়রা সেই আলোয় আসতে পারেন না। আর প্রথম হওয়ার এই দৌড়টা নিজের মধ্যে সবসময়ই বজায় রেখেছিলেন সুব্রত রায়। তাই তো নিজের দুই ছেলের বিয়েতে খরচের বাহার দেখিয়ে তিনি অবাক করে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্ববাসীকে। সেই বিয়েতে কয়েক রাতে মোট ৫৫২ কোটি টাকা খরচ করেছিলেন সুব্রত রায়। কিন্তু প্রাইভেট জেটে চড়া সুব্রত রায়ের কাহিনীর শুরুটা হোক গ্রামবাংলার ছেলে সুব্রত রায়কে দিয়ে।

১৯৪৮ সাল, ভারত স্বাধীন হয়ে কেটে গিয়েছে এক বছর। একটা বড় অংশের মানুষ শিকড়হীন হয়ে খুঁজছেন নতুন আস্তানা। দেখছেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন সুধীর চন্দ্র রায়ও। ঢাকার জমিদার পরিবারের সুখ ছেড়ে তাঁকে চলে আসতে হয়েছিল এপার বাংলায়। তারপর সেখান থেকে সরাসরি বিহার। ওই বছরই জন্ম হয় সুব্রত রায়ের। ঠিকানা বিহারের আড়ারিয়া জেলা। ছেলে একটু বড় হতেই পড়াশোনার জন্য় বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়। নিজে পড়ে থাকলেন উত্তরপ্রদেশে। সুব্রত রায়ের স্কুল জীবন কাটল শহর কলকাতায়। এখানে হলি চাইল্ড স্কুলে নিজের পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি চলে যান উত্তরপ্রদেশে। ততদিন সুব্রতর বাবা সেখানে একটি কারখানায় কাজ করে বাকি পরিবারকেও নিয়ে চলে এসেছিলেন। অগত্যা সুব্রত রায়কেও ফিরে যেতে হল পরিবারের কাছে।

ঢাকা থেকে বাংলা, তারপর বিহার, সবশেষে স্থায়ী ঠিকানা হল উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর। সেখানকারই একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে নিজের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনা শেষ করলেন সুব্রত। এতটা সুব্রত রায়ের জীবনের গল্পটা ছিল আর পাঁচজনের মতোই। কলেজের পড়ার সময় থেকে চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখা, একটা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু তা হল না। এরপর যেন গোটা ব্যাপারটাই পুরোপুরি ভাবে উল্টেপাল্টে গেল। আর আগামী কয়েক দশকের জন্য সুব্রত রায়কে তাঁর ভাগ্য যেন তাঁকে ‘অমর’ করে দিয়ে গেল।

দিগন্তে সূর্য

কলেজ শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে যেন আশ্রয় হারিয়ে ফেললেন সুব্রত রায়। এই আশ্রয় ছিলেন তাঁর বাবা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। বড় ছেলে হওয়ার কারণে বাবার পরে দায়িত্ব গিয়ে পড়ল সুব্রতর উপর। সুতরাং, চাকরি খোঁজার ‘বিলাসিতা’ ছাড়তে হল তাঁকে। খুলে ফেললেন নিজের ব্যবসা। সংস্থার নাম জয়া প্রোডাক্টস। পাপড়, নিমকি এই ধরনের খাবার প্যাকেটে ভরে নিজের বাবার রেখে যাওয়া স্কুটার চেপেই বিক্রি করতে যেতেন তিনি। কিন্তু ব্যবসা খুললেও, তা যে খুব একটা চলত এমন নয়। আয় হচ্ছিল, কিন্তু তা দিয়ে গোটা জীবন চালানো যাবে, এমনটা নয়।

এই সব করতে করতেই ৩০ বছর বয়সে পা দিলেন সুব্রত রায়। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্ত্রীর দায়িত্ব, পরিবারের দায়িত্ব, সব কিছু নিয়েই তিনি একেবারে জর্জরিত। ১৯৭৮ সাল নিজের স্ত্রীর বুদ্ধিতেই নতুন একটি ব্য়বসা শুরু করলেন সুব্রত রায়। নাম দিলের সাহারা ইন্ডিয়া পরিবার। উত্তর প্রদেশের একেবারে গ্রামের মানুষ সুব্রত দেখেছিলেন, দিনমজুর শ্রেণির মানুষদের সঞ্চয় বলে কিছু হয় না। যা আয়, তাই ব্যয়। আর এই শ্রেণিটাই হয়ে উঠল সুব্রত রায়ের ‘টার্গেট’।

ধীরে ধীরে নানা এলাকায় ঘুরে ঘুরে সুব্রত রায় ওই দিনমজুরদের থেকেই তাদের আয়ের একটা ছোট্ট অংশ নিলেন বিনিয়োগ হিসাবে। প্রথমে মানুষ এগিয়ে না এলেও, যা হয় আর কি, সময়ের সঙ্গে লোকের মুখে মুখে শুনে সবাই সেই সাহারায় বিনিয়োগ করা শুরু করে। কিছু সময়ের ব্যবধানে বিনিয়োগকারীরাও সুদ সমেত মোটা টাকা পেতে শুরু করল। এই থেকে শুরু সাহারার পথ চলা। প্রথম মাসে মোট ৪৮ জন বিনিয়োগকারীকে জোগাড় করেছিলেন সুব্রত রায়। পরবর্তীতে যা পরিণত হয়েছিল কয়েক কোটি বিনিয়োগকারীতে।

সুব্রতর জীবনে নতুন অধ্যায়

১৯৮৭ সালে সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারের ‘ম্যানেজিং ওয়ার্কার’ পদে বসলেন সুব্রত রায়। মাথায় রাখবেন, ডিরেক্টর নয়। ওয়ার্কার। তিনি যে আর সকলের মতো তা বোঝাতেই ছিল এই পদ। এই বছর থেকেই নিয়োগ শুরু করে সাহারা। ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছিল এজেন্ট। প্রথমে কিছু টাকার বিনিময়ে তাদের সাহারার কোনও প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হত। তারপরেই মিলে যেত ‘এজেন্ট’ পদ। এবার সেই ‘এজেন্ট’ পরিচয়েই আরও মানুষকে বিনিয়োগ করাতে পারলেই থাকত কমিশন। একটা সময় পর সাহারা পরিবার এতটা বড় হয়ে গিয়েছিল যে দেশে ভারতীয় রেলের পর সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান জোগানো সংস্থার তালিকায় ছিল এটির নাম।

সাহারার এই রঙিন সময় প্রায় সবাই জানে। একজনের বিনিয়োগ করা টাকা অন্যজনের হাতে তুলে বছর বছর নিজেকে দেশের বাজারে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে তারা। কিন্তু এই এর পতন হল কীভাবে? আরও ব্যবসা শুরু করা নাকি বিশ্বজুড়ে নিজের পরিচিতি ছড়িয়ে দেওয়া। নাকি একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন? ভাবছেন নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন কীভাবে পতনের কারণ হতে পারে? হতে পারে।

নামল আঁধার

১৯৯৬ সাল সাহারার রকেটের গতি নজরে এল লখনউয়ের আয়কর বিভাগের অ্যাসিস্ট্য়ান্ট কমিশনার প্রসেনজিৎ সিংয়ের। সাহারায় কারা বিনিয়োগ করে? হাই প্রোফাইল কতজন রয়েছেন? এমনকি বেশ কিছু VIP-দের নাম উল্লেখ করে তাদের বিনিয়োগ সম্পর্কে জানতে চান ওই আয়কর কর্তা। সাহারা জানায়নি। উল্টে চিঠি আসার পরদিন গোটা দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপন ছাপায় তারা। যে বিজ্ঞাপনে সেই VIP দের কথা উল্লেখ করে সাহারা। তারাও যে সাহারাতেই বিনিয়োগ করেছে, সেই কথাটাই লেখে সংস্থা। এরপর ওই আয়কর কর্তার ট্রান্সফার হয়ে যায়। আর সাহারাও চলতে থাকে নিজের মতো।

কিন্তু এই একটা ঘটনাই সাহারাকে ঘিরে অনেকগুলো প্রশ্ন তৈরি করে দিয়েছিল। সুব্রত রায়ের ‘নেটওয়ার্ক’, দেশ-বিদেশের খ্য়াতনামা ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ওঠা-বসা, হাজার হাজার একর জমি কিনে তাতে সাহারার নামে শহর তৈরির ঘোষণা, ভারতীয় ক্রিকেট টিমে বছরের পর বছর স্পনসর, সবই যেন কিছু প্রশ্ন রেখে গিয়েছিল।

একাংশ মনে করে সুব্রত রায়ের এই সাম্রাজ্য পতনের নেপথ্যে দু’টি কারণ রয়েছে, এক ২০০৫ সালের সাহারার নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত। দুই ২০১০ সালে সালে ন্যাশনাল হাউসিং ব্যাঙ্কের কাছে যাওয়া চিঠি।

  • প্রথমে ২০০৫ সালের কথায় ফিরে আসা যাক, এই বছর সাহারা হঠাৎ করেই মধ্য়স্থতাকারী এজেন্টদের সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। প্রকল্পে বিনিয়োগকারীদের তারা জানিয়ে দিল, আর এজেন্টদের টাকা দেবেন না। নিজেরা গিয়ে অফিসে প্রকল্পের টাকা জমা দেবেন। কিন্তু বহু মানুষই তা পারলেন না। ফলত, বিনিয়োগ খেলাপির অভিযোগে তাদের টাকা বাজেয়াপ্ত করল সাহারা। ক্ষোভ চড়ল মানুষের। কমতে শুরু করল বিনিয়োগ। কিন্তু গতি থামালেন না সুব্রত। কিনলেন বিমান, তৈরি করলেন নিজের ‘হোয়াইট হাউস’। এমনকি, ১০ হাজার একর জমির উপর একটি আধুনিক শহর তৈরির কাজেও নামলেন তারা।
  • আর একটি ঘটনা ঘটে ২০১০ সালে। দেশের ন্য়াশনাল হাউসিং ব্যাঙ্ক চিঠি পাঠালেন পুনের এক যুবক। তিনি দাবি করেন, হাউজিং বন্ড ব্যবহার করে সুব্রত রায় বড় কোনও গড়মিল করছে। ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাঙ্ক সেই চিঠি পাঠিয়ে দেয় সেবির কাছে। এরপরই শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরে চলে আসেন সুব্রত রায়।

কিন্তু সেবির সঙ্গে সাহারার সমস্যাটা কোথায় হয়েছিল? অভিযোগ, সাহারা OFCD পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীদের থেকে টাকা তুলেছেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, OFCD মাধ্যমে টাকা তোলার যে নিয়ম রয়েছে সেই অনুযায়ী একটি সংস্থায় মাত্র ৫০ জন বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করতে পারবেন। এই সংখ্যা তার বেশি হলে, ওই সংস্থাকে নিজেদের পাবলিকলি এনলিস্টেড করতে হবে। অর্থাৎ শেয়ার বাজারে নিয়ে আসতে হবে। যা সাহারাশ্রী সুব্রত রায় চাননি। কারণ, সেবির কাছে দ্বারস্থ হওয়া মানে সংস্থার সমস্ত নথিপত্র মেলে ধরা। যা হয়তো তাঁর জন্য চাপেরই ছিল। কিন্তু তারপরও নিজেদের অন্য একটি সংস্থা সাহারা প্রাইম সিটিকে এনলিস্ট করতে সেবির কাছে দ্বারস্থ হন সাহারাশ্রী। যার মাধ্যমে প্রথম বেরিয়ে OFCD দুর্নীতির কথা। পরবর্তীতে এই একটা ঘটনাই গোটা দেশের সামনে মেলে ধরেছিল সাহারার পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি। যেখানে হস্তক্ষেপ করতে হয় সুপ্রিম কোর্টকেও। সাহারাশ্রীকে মানুষের ২৫ হাজার কোটি টাকা ফেরত দিতেও বলা হয়। কিন্তু তা তারা পারেনি। অবশেষে ২০১৪ সালে জেল এবং ২০২৩ সালে মৃত্যু। সাহারার লুকানো অধ্যায় নিজের সঙ্গে নিয়েই যেন চলে যান সুব্রত। গত শনিবার নতুন করে সুব্রত রায়ের পরিবারের সদস্য-সহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে ইডি। কলকাতার পিএমএলএ আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করেছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু তদন্ত কি নতুন করে গতি পাবে? সুব্রত দুই ছেলের ঠিকানা কেউ জানে না। সাধারণের টাকা কোথায় গেল, তা কি আর জানা যাবে, প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর অধরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *